‘আতঙ্কের পৃথিবীতে বীর হওয়া সম্ভব নয়’—মাসরুর আরেফিন

 [গতকাল ঢাকা লিট ফেস্টে বাংলা একাডেমির লনে

আমার এক ঘণ্টার আলোচনা চলেছে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে। মূলত কথা বলেছি আমার লেখাগুলোয় ‘state phobia‘ বা রাষ্ট্রাতঙ্ক নিয়ে। আরও যা-যা বলেছি তার মধ্যে পড়ে: এই সিস্টেম, এই সিস্টেমকে ভাঙার বা মোকাবিলা করার বিমূর্ততা, লেখায় মেটিফিজিক্যাল অ্যাবস্ট্রাকশন কেন নেসেসারি এক অ্যাবস্ট্রাকশন, নন্দনের স্বার্থে লেখায় রোমান্টিক গদ্য বা অন্য কোথাওর বা অন্য কোনো পৃথিবীর আবাহন জাগানো গদ্য আমরা কেন ও কোন্ চালাকি থেকে লিখি, বাংলাদেশের বর্তমান গভর্নমেন্টালিটি কোন্ মেন্টালিটি, ‘জ্ঞান‘ কেন ও কীভাবে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করবে দেশের বিরাট সংখ্যার মানুষকে মানুষ বলেই না ভাবতে, আর ওভারঅল কী লিখছি, কেন লিখছি ইত্যাদি। সঞ্চালক খুব ভাল ছিলেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও লেখক মোস্তাক আহমেদ। ভালই তিনি আমাকে উসকে দিয়েছেন বারবার এবং ভালই আমরা আলাপ করেছি সাহিত্যে সো-কল্ড ইতিবাচকতা বনাম সো-কল্ড নৈরাজ্য ফেরি করা নিয়ে। নিচে থাকল আজকের ‘বাংলা ট্রিবিউন‘ পত্রিকার এ সংক্রান্ত খবর (দু জায়গায় সামান্য কারেকশন করে)।]

——

এই সময়ের পৃথিবী বীরের নয় উল্লেখ করে কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘দেশপ্রেম এখন প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এই আতঙ্কের পৃথিবীতে বীর হওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা ফুল, লতা, পাতা আর শৈশবের বনরুটির জন্য হাহাকারের কথা বলি সাহিত্যে। আমি পাঠকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিই এর ভেতর রূপকধর্মিতা যাচাইয়ের দায়। আমার চারটি উপন্যাসই "রাষ্ট্র"বিরোধী। সেগুলোতে আমি যেসব উৎসর্গ ব্যবহার করেছি, তা একেকটি মুখোশ।’


ঢাকা লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে বাংলা একাডেমির লনে 'কথাসাহিত্যের ভিতর বাহির' শীর্ষক সেশনে ‘বর্তমান সময়ের সাহিত্যে নতুন প্রোটাগনিস্ট আনা যায় কিনা’—দর্শকের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সেশনটি সঞ্চালনা করেন মোস্তাক আহমেদ।

বর্তমান সময়ের আলোচিত কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন তার স্বভাবসুলভ ব্যতিক্রমী বাচনভঙ্গিতে নিজস্ব সাহিত্য ভাবনা এবং সমকালীন সাহিত্যের হালচাল সম্পর্কিত আলোচনায় মুগ্ধ করেন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের।

সেশনের শুরুতে সঞ্চালক প্রধান আলোচকের ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যকর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। লেখকের শৈশব স্মৃতি তার লেখায় বারবার উঠে এসেছে, সে বিষয়ক আলোচনায় উত্থাপন করলে লেখক জানান, তার ‘আড়িয়াল খাঁ’ ও ‘আলথুসার’ উপন্যাসে তিনি শৈশবের কথা বলেছেন। শৈশবের গল্প বলা তিনি শিখেছেন মার্সেল প্রুস্ত ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে।

লেখক একপর্যায়ে বলেন, ‘বইকে আমি পণ্য হিসেবেই দেখি’। এই বক্তব্যের সূত্রে সঞ্চালক প্রশ্ন করেন, ‘পাঠক মাসরুর আরেফিনের লেখক সত্তা নিবেদনের প্রশংসা করেন, আর লেখক নিজে তার বইকে পণ্য বলছেন, এ ব্যাপারে তাঁর মতামত কী?’ এর জবাবে মাসরুর আরেফিন জানান, লেখার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিবেদন রাখে তার লেখক সত্তা, আর ছাপার পর বইয়ের প্রচার ও বিপণনে তিনি অন্য যেকোনও পণ্যের মতোই সতর্কতা ও সংবেদনশীলতায় জোর দেন।

উপন্যাসকে একান্তই আখ্যান হিসেবে ভাবেন নাকি তাতে তত্ত্বগত বিষয়ও আসে—এমন প্রশ্নের জবাবে মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের মাঝেই আছি। ইতিহাসই আমার লেখার উপজীব্য। আমরা ইতিহাস নির্মাণ করি না। ইতিহাস আমাদেরকে নির্মিত করেই রেখেছে। আমার লেখার মেরুদণ্ড হলো আমার দর্শন।’ এক দর্শকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশের ইতিহাসের যে পর্যায়ে আমরা আছি, তাতে আর কারও ডাকে কোনো ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর আমাদের দরকার নেই। আপনাকে যারা ঐক্যমত্যের কথা বলে ডাকবে, তাদের নিয়ত ও প্রজেক্ট জানবেন বিপজ্জনক।‘

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন